কৈশোরকালীন পুষ্টির গুরুত্ব

 কৈশোরকালীন পুষ্টির গুরুত্ব জীবনকে সুন্দর, সুখময় ও সার্থক করে তুলতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সুস্থ, সবল ও সতেজ দেহ। আর এজন্য যথাযথ পুষ্টির দরকার। একটি সমাজের সর্বাঙ্গীণ অবস্থার ওপর ওই সমাজের সদস্যদের পুষ্টির মান নির্ভরশীল। জন্মের পর মানুষের প্রথম প্রয়োজন খাদ্য। এ খাদ্যই পুষ্টির বাহক। যেসব খাদ্য দেহের, বৃদ্ধি, গঠন, ক্ষয়পূরণ ও জনশক্তির বিকাশ ঘটায় তাদের পুষ্টিকর খাদ্য বলা হয়। এ ধরনের খাদ্য যখন দেহের সুস্থতা আনে, তখন বলা হয় পুষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, পুষ্টি হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে খাদ্য শারীরিক বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং শক্তি উৎপাদনের কাজ করে থাকে। খাদ্যে ৬টি প্রধান পুষ্টি উপাদান থাকে। এগুলো হলো-কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিনস, মিনারেল এবং পানি। এ পুষ্টি উপাদানগুলোই শরীরের বিপাককে সচল রাখে, সর্বপ্রকার কাজের শক্তি জোগায় এবং শরীর সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।

কৈশোরকালীন পুষ্টি - কার্যক্রম বাস্তবায়নে ২০২৪

সাধারণত ১১ থেকে ১৯ বছর সময়টাকে কৈশোরকাল হিসেবে ধরা হয়। এ সময় ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। শরীরের বর্ধন সাধারনত এই সময়ে হয়ে থাকে। অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগে, যার কারণে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময় অনেক কিশোর-কিশোরীরা আবার অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার সমস্যায়ও ভুগে থাকে শুধুমাত্র তাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসের কারণে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস মানুষকে অস্বাভাবিক ভাবে সৃষ্টি করে।

কৈশোরকালীন পুষ্টির গুরুত্ব


 কৈশোরে ছেলেমেয়েদের জন্য স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার তালিকায় অবশ্যই নিচের উপাদানগুলো রাখতে হবে। যে গুল সঠিক সময়ে সুস্থ ও সবল শরীর এর জন্য অত্যন্ত জরুরী।

ক্যালরি : এ সময়ে কিশোরদের জন্য ২৪০০-৩২০০ ক্যালরি এবং কিশোরীদের জন্য ১৬০০-২৪০০ ক্যালরির স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার দিতে হবে।


প্রোটিন : প্রতিদিন উচ্চ প্রোটিনযুক্ত (৪৫-৬০গ্রাম) খাবার দিতে হবে, কারণ এ সময়ে তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ও পেশি গঠন হয়। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, পনির, শিমের বিচি, সূর্যমুখীর বিচি, সয়াবিন, ডাল, বাদাম এগুলো খেতে দিতে হবে।

কার্বোহাইড্রেট : খাবার তালিকায় মোট ক্যালরির ৬০% কার্বোহাইড্রেট রাখতে হবে। ভাত, আটা, আলু, গম এগুলো পরিমান মতো খেতে হবে।


ক্যালসিয়াম : কৈশোরকালে ছেলে-মেয়েদের হাড় বৃদ্ধি পায় এবং গড়ন মজবুত হয়। তাই এ সময় প্রতিদিন ১২০০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন- সামুদ্রিক মাছ, পনির, দুগ্ধজাতীয় খাবার, গরুর কলিজা, যকৃত পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে।


আয়রন আয়রনের অভাবে ৪৩% কিশোরী রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। প্রতিদিন ১২ মি.গ্রা. কিশোরদের এবং ১৬ মি.গ্রা. আয়রন কিশোরীদের দিতে হবে। সেজন্য সবুজ শাক-সবজি, ফলমূল, বিট, কচু, কলা, ডালিম, কালো আঙ্গুর, আপেল- এগুলো খেতে হবে।


ভিটামিন ও মিনারেল দেহে ভিটামিনের অভাব থাকলে রক্ত স্বল্পতা, রাতকানা, বেরিবেরি, ঠোঁটে ঘা, দাঁত থেকে রক্তপড়া, চোখে কম দেখা, মানসিক অবসাদ গ্রস্থতা, দুর্বলতাসহ নানা রোগ দেখা দিবে । যেসব খাবারে প্রচুর ভিটামিন পাওয়া যায় সেগুলো হলো- আম, কাঁঠাল, কলা, জাম্বুরা, পেঁপে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ঢেঁড়স, ডিম, আলু, চিজ, কলিজা, দুধ, পেয়ারা, পালংশাক, লালশাক, পেয়ারা, টমেটো, শিমেরবিচি, বাদাম, ঢেঁকি ছাঁটাচাল, মাছ, মাংস ইত্যাদি। এসব খাবারের পাশাপাশি স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি যাতে না হয়, সে জন্য তৈলাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে।

জীবনের অন্যতম সময়  :

কৈশোরকালীন পুষ্টির গুরুত্ব


কিশোর বয়স প্রত্যেক মানুষের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সের সুস্বাস্থ্য পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি। পুষ্টির মাধ্যমেই শারীরিক বৃদ্ধি, কোষের ক্ষয়পূরণ ও দেহে শক্তি উৎপাদিত হয়। এই শক্তি দিয়ে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা, চলাফেরা করে, পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে। সঠিক পুষ্টির জন্য এই বয়সে প্রয়োজন সুষম খাবার। যার মধ্যে থাকবে প্রোটিন, চর্বি, শর্করা, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি।

বয়ঃসন্ধিকালে স্বাস্থ্যকর খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই সময়ে শরীরের পরিবর্তন একজন ব্যক্তির পুষ্টি এবং খাদ্যের চাহিদাকে প্রভাবিত করে । কিশোর-কিশোরীরা আরও স্বাধীন হয়ে উঠছে এবং নিজেরা ই অনেক খাবারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অনেক কিশোর-কিশোরীর বৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রয়োজন হয়।


কৈশোর বয়সে পুষ্টির গুরুত্ব

এই বয়সে অনেকের মধ্যে স্থূলতা দেখা দেয়। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম কম করা, শুয়ে–বসে সময় কাটনো। সন্তানসংখ্যা কম হলে অনেক মা-বাবা তাঁদের বেশি বেশি খাবার দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে সকালের নাশতা না খেয়ে দুপুরের পর থেকে অনবরত খেতে থাকে। ওটাও ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ। হরমোনের সমন্বয়হীনতার জন্যও ওজন বেড়ে যেতে পারে। তবে অসুস্থতা ছাড়া যদি ওজন বেড়ে যায়, সেটাকে সহজেই আয়ত্তে আনা সম্ভব।

কৈশোরের সময়টায় হরমোনের কারণে দেহে পরিবর্তন আসে বলে কারও ওজন কমে যায় বা বেড়ে যায়। কারও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। কারও চেহারায় কামনীয়তা কমে যায়। কারও মেজাজ রুক্ষ হয়ে যায়। এ জন্য তাদের খাবারে থাকতে হবে কলিজা, ডিম, বাদাম, খেজুর, কিশমিশ, কচুশাক, ছোট মাছ, বেদানা, সফেদা, পেয়ারা, আপেল, আমলকী, লিচু ইত্যাদি। যেগুলো রক্তস্বল্পতা রোধ করবে।

দেহের বৃদ্ধি ও হাড় মজবুতের জন্য ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। এ জন্য খেতে হবে দুধ, দুধজাতীয় খাবার, দই, পনির, সমুদ্রের মাছ, সবজি, ডিম, পোস্তাদানা, সয়াবিন, মাখন, ঘি, মাছ ইত্যাদি। ভিটামিন সির জন্য পেয়ারা, আমলকী, আমড়া, জাম্বুরা, কমলা, মাল্টা, লেবু খেতে হবে। প্রতিদিন এক গ্লাস লেবুর শরবত পান করা খুবই উপকারী অভ্যাস। জিঙ্ক ও ফলিক অ্যাসিডের জন্য খেতে হবে সমুদ্রের মাছ, গরুর মাংস, ব্রকলি, লেটুসপাতা, পানি, ডাল, পাতাজাতীয় সবজি ইত্যাদি।

ওজন বাড়লে সমস্যা :

এই বয়সে ওজন বেড়ে গেলে বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, কোলেস্টেরল ও ট্রাইস্লাইসেরাড বৃদ্ধি, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি। মেয়েদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এটা প্রজনন ক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

ছেলেমেয়েদের ওজন বেড়ে গেলে অনেক মা-বাবা তাদের ডিম-দুধ-মাংস খাওয়ানো থেকে বিরত রাখেন। অথচ এই বয়সে এসব খাবার প্রয়োজন দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও মস্তিষ্কের গঠনের জন্য। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তির জন্য। দুধের বদলে ডাল-বাদাম-সয়াবিন-দই-শিমের বিচি দেওয়া যেতে পারে।

সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য কিছু বিষয় মা–বাবাকে মনে রাখতে হবে।

 সুষম ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। আঁশ পাওয়া যাবে ডাল, আটার রুটি, শাক-সবজি ও ফল থেকে। আঁশ কোষ্টকাঠিন্য থেকে রক্ষা করবে।

• খেতে হবে টক-মিষ্টি মৌসুমি ফল।

• অতিরিক্ত তেল-চর্বি না খাওয়া ভালো। তবে তেল, ঘি, মাখন একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না।

• বাইরের খাবারের আসক্তি রোধ হবে। কারণ, এসব খাবার মেওনেজ, মার্জারিন, সয়াসস, কেচাপ, স্বাদ লবণ (টেস্টিং সল্ট) দিয়ে তৈরি; যা স্বাদগ্রন্থিকে পরিবর্তিত করে ফেলে। এ কারণে সেসব বাচ্চার বাড়ির তৈরি খাবার খেতে ভালো লাগে না। অথচ স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বাইরের এই খাবারগুলো ভালো নয়।

• সকালের নাস্তা ঠিকমতো খেতে হবে। এই নাস্তা সারাদিনের শক্তির জোগান দেবে।

• অপুষ্টি সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে। অপুষ্টি কেবল দরিদ্রদের মধ্যে হয় না। পুষ্টিকর ও সুষম খাবারের অভাবে সচ্ছল পরিবারেও অপুষ্টি দেখা দেয়।

• প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার যত কম খাওয়া যায়, তত ভালো।

• ভিটামিন ডির জন্য খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিন পাঁচ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকা প্রয়োজন।

• অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে না খাইয়ে রাখা যাবে না। এতে খাবার গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

• পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।

• শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে হবে। এ জন্য ঘরের কাজ ও খেলাধুলার অভ্যাস করতে হবে।

• দীর্ঘ সময় টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত না থাকাই ভালো।

কিশোর–কিশোরীদের পুষ্টি ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা জানার জন্য মাঝেমধ্যে তাদের ওজন–উচ্চতা মাপতে হবে। তারা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ও পড়াশোনায় অমনোযোগী হলে বুঝতে হবে তাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের অভাব হচ্ছে। ওজন কমানোর জন্য কখনই তাদের ডায়েট করা উচিত নয়। এতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেবে। সুষম ও পরিমিত খাবার এবং ব্যায়ামই পারে তাদের ওজন আদর্শ মাপে রাখতে।

কৈশোরকালীন পুষ্টির গুরুত্ব


কিশোর বয়সে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন হয়। এ সময় তারা যথেষ্ট খেলাধুলা করে, খাবারের প্রতি তাদের চাহিদা থাকে, অনেক সময় তারা ভুলভাল খাবার খেয়ে ওজন বৃদ্ধি করে, এ সময় তাদের মানসিক অস্থিরতা বাড়ে এবং মনোজগতেও নানা পরিবর্তন হয়। এমনকি এ সময় তাদের জীবনবোধ ও গড়ে ওঠে এ রকম আরও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা এ সময়টা পার করে। এ সময় তাদের পুষ্টিকর খাবার বেশি প্রয়োজন। এতে তাদের শরীর ও মন যেমন গঠিত হতে সাহায্য করবে, তেমনি তাদের মেধার বিকাশে যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। আর এ সময় যদি তারা নিজেরাই জানতে পারে কোন খাবার তাদের কিভাবে খেতে হবে, তাহলে তারা সেটা ভালোভাবে ফলো করবে। পুষ্টিকর খাবার মানে দামি খাবার নয়। আমরা বলছি, প্রত্যেকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাবে। তাদের মা-বাবার আয়ের ওপর তা নির্ভর করবে। তবে মনে রাখতে হবে, তাদের আয়ত্তের মধ্যে বেস্ট জিনিস খেতে হবে। 

সবশেষে বলতে চাই,  সবসময়ে তাদের নিয়ম মেনে খাবার খেতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, জিঙ্ক, আয়রন ও প্রোটিন প্রয়োজন। এ সময় কিশোর–কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর খাবার রান্না করে খেতে পারে। এতে তাদের  একঘেয়েমি যেমন দূর হবে, তেমনি মানসিক দিক থেকেও তারা সুস্থ থাকবে। 

    ''তৈল- চর্বি যুক্ত খাবার ও জাঙ্ক ফুড পরিহার করি, চল সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ি"

Next Post Previous Post