চিকিৎসার নামে হাসপাতাল ক্লিনিক গুলোতে এসব কি হচ্ছে
স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যার তুলনায় হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় কম। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর উপর রোগীর চাপ অনেক বেশি, ফলে অনেক রোগী বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার নামে অনিয়মের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
অনিয়মের ধরনসমূহ
১. ভুল চিকিৎসা ও অপারেশনে অবহেলা
ভুল চিকিৎসা বা অপারেশনের কারণে অনেক রোগীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। এটি দুই ধরনের হতে পারে:
- ভুল ডায়াগনোসিস: সঠিক রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থতা।
- অপারেশনে ভুল: অপারেশন থিয়েটারে অপারেটিং স্ট্যান্ডার্ড মেনে না চলা বা দক্ষতার অভাব।
২. অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসা
অনেক বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ওষুধ এবং অপারেশনের জন্য চাপ দেয়।
- একটি সাধারণ সমস্যা চিকিৎসার জন্যও অনেক সময় অতিরিক্ত পরীক্ষা দেওয়া হয়।
- কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয় অপারেশনও করা হয়, শুধুমাত্র আর্থিক লাভের জন্য।
৩. বিল বৃদ্ধি ও আর্থিক শোষণ
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একাংশ অতিরিক্ত বিল চাপানোর জন্য কুখ্যাত।
- একজন রোগীকে ভর্তি করার সময় একটি অনুমানিত খরচ বলা হয়, তবে শেষ পর্যন্ত খরচ অনেক বেশি হয়ে যায়।
- অপ্রয়োজনীয় পরিষেবা বা প্যাকেজ বিক্রির মাধ্যমে রোগীকে আর্থিকভাবে শোষণ করা হয়।
৪. স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন
কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না।
- অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় না।
- পরিবেশে অপরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে, যা রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. অনভিজ্ঞ ও অপ্রশিক্ষিত কর্মী
অনেক ক্লিনিকে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মীদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
- লাইসেন্সবিহীন চিকিৎসক দিয়ে রোগী দেখা।
- নার্স বা অন্যান্য কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব।
৬. রোগীদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ
হাসপাতালের কর্মীরা অনেক সময় রোগী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।
- জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় অমনোযোগী হওয়া।
- মানবিক আচরণের ঘাটতি দেখা যায়।
অনিয়মের প্রভাব
এই অনিয়মগুলো রোগী ও তাদের পরিবারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
১. রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি
ভুল চিকিৎসা, অপ্রশিক্ষিত কর্মী, এবং স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের কারণে রোগীদের স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
২. অর্থনৈতিক ক্ষতি
অতিরিক্ত বিল বা অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রোগী ও তাদের পরিবার বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
৩. আস্থার অভাব
যখন বারবার অনিয়মের ঘটনা ঘটে, তখন জনগণের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপর আস্থা নষ্ট হয়। এটি একটি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
৪. চিকিৎসা ব্যবস্থার মান অবনতি
অনিয়মের ফলে ভালো চিকিৎসকেরাও এই পরিবেশে কাজ করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন।
সমস্যার মূল কারণ
এই সমস্যাগুলোর পেছনে কিছু মূল কারণ রয়েছে, যেমন:
- অপর্যাপ্ত নজরদারি: সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতা।
- চিকিৎসকদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব: কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতাল কেবল অর্থ উপার্জনের দিকে মনোযোগী।
- আইন প্রয়োগের অভাব: অনিয়মের জন্য যথাযথ শাস্তি না হওয়া।
- জনসচেতনতার অভাব: অনেক রোগী জানেই না যে তাদের সঙ্গে কীভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে।
সমাধানের উপায়
এই সমস্যাগুলো সমাধানে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
১. কঠোর আইন প্রয়োগ
সরকারকে এই বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
- লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধ করা।
- অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে জরিমানা ও শাস্তি প্রদান।
২. নিয়মিত পরিদর্শন ও মনিটরিং
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৩. চিকিৎসকদের নৈতিক প্রশিক্ষণ
চিকিৎসকদের নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের মান উন্নত করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
রোগীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে প্রচারণা চালানো দরকার।
- রোগীর অভিযোগ জানানোর উপায় সম্পর্কে অবগত করা।
- চিকিৎসার আগে এবং পরে কী কী পরিষেবা পাওয়া উচিত, তা বোঝানো।
৫. প্রযুক্তির ব্যবহার
স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
- অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থা চালু করা।
- চিকিৎসকদের যোগ্যতা যাচাই করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করা।
উপসংহার
চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা, যা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তবে বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে প্রচলিত অনিয়ম ও অব্যবস্থা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করছে। এই সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, এবং জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব, সঠিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সচেতন থাকা এবং যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।